Eid Story, Asma Khan ঈদ’ কথা আসমা খান
শবেবরাতের পরেই কিন্তু ঈদের প্রস্তুতি বাতাস বইতো তখন। চারিদিকে কেমন যেন খুশী খুশী ভাব। ঘরে তখন হিসেব কিতেব চলতো দেয়া থোয়ার আয়োজনে। যাকাতের গাট্টি গাট্টি শারী–লুঙ্গি। ফেতরার টাকা। ঘরের ছেলে মেয়েদের কাপড়–চোপড়, চুড়ি–ফিতে, জুতো। মা চাচীদের শাড়ী, ছায়া, ব্লাউজ। কাছের মানুষদের বয়স হিসেবে সাধ্য অনুযায়ি এটা সেটা। রিক্সা বোঝাই ঐ সব বাজার যখন ঘরের দরজায় থামতো, উরেব্বাস! আমাদের আনন্দ দেখে কে?
ঢাউস ডিক্সোনারির মধ্যিখানে চ্যাপ্টা, শুকিয়ে রাখা ফুল পাতার সাথে রংপেন্সিলে আঁকা, কবিতা লেখা রাইটিং প্যাডের নীল সবুজ দামী কাগজে হাতে বানানো আমাদের চমৎকার সেই সব ঈদকার্ডে বন্ধুদের শুভেচ্ছা ও আমন্ত্রন জানাতে হতো যে! ঈদের আগের দিনে সারা পাড়া চষে মেন্দি আনতাম কোচরভর্তি করে। মশলা পেশার শিল–পাটা ছোবড়া দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে মেন্দি বাটার হ্যাপা কিন্তু কম ছিল না। সন্ধে বেলায় রান্না ঘরের কাঠবাদাম, পেস্তাবাদাম ছিলে দিয়ে হাতে মেন্দি দিতাম, বেশি লাল হবার আশায় কলাপাতা দিয়ে মুড়ে হাতে মেন্দিসহ ঘুমুতে যেতাম।
কোন জাদুর ছোঁয়ায় আমাদের চেনা পাড়াটা একদম অন্যরকম হয়ে যেত সকালে। আমরা নুতন কাপড় পরে সেজে গুজে সেমাই ফিরনি খেয়ে বারান্দায় বসে দেখতাম। দূরদূরান্ত থেকে বাসার কাছের ঈদ্গাহে মানুষ আসত ঈদের নামাজের জন্য। গরীব দুঃখীরা যাকাতের কাপড় আর ফেতরার টাকার জন্য, কিছু ভালো মন্দ খাবার আশায় আসতো। নামাজ শেষে নামাজীদের কোলাকুলি, আমাদের মুরুব্বিদের সেলাম করে সেলামি নেয়ার বিমল আনন্দ, বাজি, পটকার শব্দ, দল বেঁধে ঘুরতে যাওয়া। বাতাসে উৎসবের খাবারের সুবাস। রান্না ঘরে দ্রুত হাতে মা খালাদের মজাদার পোলাও, ভুনাখিচুরি, কোর্মা, রেজালা রান্নার বিশাল আয়োজন। রেডিয়োতে সুরের ঝংকার ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ… …’।
২
বিলেতের ছবির মত সাজানো ছিমছাম সেই সাহেব পাড়াতে মোট চার ঘর রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী, আর তাদের বাসার ভাড়াটে আমরা সপরিবারে চার ঘর গ্র্যাড স্টুডেন্ট, তিন চার ঘর পাকিস্তানী, আর এক ইরাকী পরিবারের বসবাস। প্রথম বছরেই আমরা ক্রমাগত জেদি চেষ্টায় দেশের হরেক রকমের মিষ্টি বানানো শিখে গেলাম। দেশ থেকে নেয়া ঈদের শাড়ী পাঞ্জাবি তো ছিলই। আঠারো উনিশ ঘন্টার রোজায় একেবারে হয়রান, বাসার সবচেয়ে কাছের মসজিদ বাসে করে সোয়া ঘন্টার পথ। আমার স্বামী ঈদের খোঁজ নেবার জন্য ফোন করে দেখেন মুয়াজ্জিন সাহেব শুধু নিজ দেশি ভাষায় বাতচিত করতে পারেন। ঈদের চাঁদ উঠেছে কিনা সেটা তিনি সে ভাষায় অনভিজ্ঞ, জিজ্ঞেস করেন, ‘আগামীকাল চাঁদ দেখা গিয়া হ্যায়?’… …
সে যাহোক, ঈদের দিন সকালে নামাজ শেষে আমরা সেমাই, মিষ্টি, লুচি কোর্মা দিয়ে নাস্তা খেয়ে গ্র্যাড স্টুডেন্টরা সদলবলে গেল ভার্সিটি, আর মহিলারা দল বেঁধে পাকিস্তানিদের বাসায় বেড়াতে গেলাম। ‘মুলুক সে আয়া’ তাদের ঝলমলে সালোওয়ার কামিজ দেখার মত। দইবড়া, কাবাব, বিরিয়ানী, হালুয়া খেয়ে বলি, ‘সত্যি তোমাদের কাবাবটা খুবই মজার’। তারাও ঢালাও প্রশংসা করে আমাদের ছানার মিষ্টির। মহিলাদল সহ এরপর ইরাকী বাসায় বেড়াতে গিয়ে বুঝতে পারি তারা আগেরদিনেই ঈদ করেছে। ইরাকীদের পোষাক আষাক বিলাতীদের মতই তো। আমাদের উনারা বাকালাওয়া আর বিভিন্ন রকমের বেক করা সৌখিন পেস্ট্রি দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। সন্ধ্যে বেলায় অন্য পাড়ায় আমাদের বন্ধুর বাসায় ট্যাক্সি করে যাবার সময় দেখি বিলাতি ক্যাব ড্রাইভার সহাস্যে আমাদের বলছে ‘ঈ… ই… ড মোবারক’!!
তিন
সেবার রোজার শেষ দশদিন মক্কায় কাটানোর ইচ্ছে হোল। আলো ঝলমল অত্যাধুনিক মেগাশহর মক্কা, পবিত্র তীর্থকেন্দ্র, সমস্ত পৃথিবীর মুসলমানদের মিলন মেলা। হোটেল থেকে হারাম শরিফে যাবার চড়াই উৎরাই হাঁটা পথে চাঁদি–ফাটা গরম, গিজ গিজে জনারন্য, আর পথের দুইধারে ঝলমলে বানিজ্য পশরা। সাতাশের রাতে তারাবী পড়ে মধ্য রাতে হোটেলের আস্তানায় আমাদের দিয়ে আমার স্বামী আবার ফিরে গেলেন তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে একবারে সেহেরির খাবার কিনে ফিরবেন। ওমা কি কান্ড!! তিনি হাঁফাতে হাঁফাতে ফিরে এলেন ভোর রাত্রে আঠাশে রমজান, কিন্তু রোজা নয়, সৌদী বাদশাহ ঐ দিন ঈদ হবে বলে ঘোষনা দিয়েছেন। চট–জলদি ঈদের কাপড় পড়ে হারাম শরিফের পথে নামলাম। প্রতিদিনের সেই পথই বদলে গেছে, খুশির ছোঁয়া সর্বত্র। নামাজের পরে এই ‘হঠাৎ ঈদের’ ফলশ্রুতি রেস্টুরেন্টে তিলধারনের জায়গা নেই। আমার স্বামি চট করে শাওরমার জন্য লাইনে দাঁড়ালেন। পাকানো লাঠির মত দেখতে ইতালীয়ান ‘বাজেতে’ ব্রেডের মাঝখানের নরম অংশ ফেলে দিয়ে মিষ্টি পেয়াজ, টমেটো, শষা পুদিনাপাতা লেবুর রস সহ গ্রিল করা শাওরমার মাংস পুরে অসম্ভব মজার সেই খাবার, সেই হঠাৎ ‘ঈদ’, মিলন মেলার জনারন্যর স্মৃতি এখনো অমলিন।
চার
ফ্রুট সালাদের মত ইমিগ্রান্টদের দেশ কানাডা। বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, দেশের সংস্কৃতির মিশেল। প্রথম প্রথম এদেশে এসে মুসলমানেরা নিজেদের মত করে ঈদ উৎসব করতেন। বিভিন্ন মসজিদে চাঁদ দেখায়, ঈদের নামাজ পড়ায় কেউ স্বদেশ, কেউ সৌদি আরব, কেউ লোকাল , আবার কেউ গ্লোবাল মতামতকে প্রাধান্য দিতেন। ফলে স্কুল কলেজে অফিস আদালতে নির্দিষ্ট একই দিনে খ্রিসমাস পালন করা খ্রিস্টান কানাডিয়ানদের সামনে মুসলমানেরা ভিন্ন ভিন্ন দিনে উৎসব উদযাপনে একটু বিব্রত পরিস্থিতিতেই পড়তেন। চিন্তাশীল কয়েকজন সামাজিক নেতার আন্তরিক, অক্লান্ত চেষ্টায় গত চার পাঁচ বছর এক সাথে রোজা, ঈদ হচ্ছে অটোয়াতে। অনেক হালাল রেস্টুরেন্ট হয়েছে। এথেনিক পোষাকের বাজার হচ্ছে বিভিন্ন কমিউনিটি বিল্ডিং ভাড়া করে। অনেক কানাডিয়ান সুপারমার্কেটের ফ্লায়ারে ‘ঈদ মোবারক’ শিরোনামে এথেনিক পন্যর সেল দিচ্ছে। হালাল মাংসও মিলছে মূলধারার কানাডিয়ান সুপার মার্কেটেই। জাকাত, ফেতরার টাকা বিভিন্ন মসজিদে সংগ্রহ করে তা উপযুক্ত প্রার্থিকে দায়িত্বের সাথে বিতরন করা হচ্ছে। অটোয়ার মুসলিম কবরস্থানেও চাইলে জিয়ারতে যেতে পারে মসজিদে নামাজের পর।
এই পরবাসে আমরা সংস্কৃতির পার্থক্যটায় বেশি সংবেদনশীল, ভৌগলিক দুরত্বতো আছেই। এমনিতেই কানাডা অনেক অনেক সহনশীল। সামাজিক, ধর্মীয় উৎসবের আচার অনুষ্ঠান পালনে কোন বাঁধা নেই। মানুষ মাত্রই সামাজিক, এই পরবাসে এসে নিউক্লিয়ার পরিবারে আমরা আমাদের পরিচিত মুল্যবোধের সন্ধানে সখ্যতা গড়ে তুলি স্বদেশিদের সাথে, অন্য দেশের বা অন্য ভাষার মানুষের সাথেও। উৎসবের সামাজিক রসায়নে তা আমাদের সমৃদ্ধ করে,আমোদিত করে। তথ্য–প্রযুক্তির কল্যানে বিশ্ব এখন খুব ছোট হয়ে গেছে। ফলে সন্ধ্যায় ঈদের চাঁদ পুবের কোন নির্জন দ্বীপে বা ভিন্ন কোন দেশে উঠলেও দিনে দুপুরেই পশ্চিমে অভিবাসি, আমাদের ফেসবুকে চাঁদ উঠে যায়, টেক্সটিঙ্গে, ইমেইলে পরেরদিন কোথায় নামাজ হবে জানা হয়ে যায়। কার বাসায় কখন ওপেন হাউজ, মেনু কি, কে কোথায় যাচ্ছে, কে কোন পোষাকে, দিন যাপনের প্ল্যান হয়ে যায় সবান্ধব!
বাড়িছাড়া ছেলেমেয়েদের চাঁনরাতেই দাওয়াত দেই গতবছর। টেবিলে তাদের পছন্দের হায়দারাবাদের মতি বিরিয়ানী, (ছোট্ট ছোট্ট আংগুরের সাইজের মাংশের কোপ্তা দিয়ে বানানো), হাঁড়িকাবাব, ছোট ছোট নুতন আলু দিয়ে মুরগী, বেগুন চাক ভাজা, কুচানো সীম, আলু, চিংড়ি দিয়ে একটা ভাজি। আমি বছরের শেষ ইফতার বানাতে ব্যস্ত। অফিস–ফেরত ছেলেমেয়েরা একে একে এসে টেবিলে চেয়ারের দখল নিচ্ছে। কিন্তু কারো মুখে তেমন কোন কথা শুনি না। সদ্য ভাজা এক ট্রে ভুজিয়া ইফতার নিয়ে টবিলে এসে দেখি সব্বাই যার যার স্মার্টফোনে, ফেসবুকে তারা একেবারে চকলেট খাওয়া মুখ করে পরমানন্দে শুভেচ্ছা বিনিময় করছে। টেবিলের ফটোসহ ঈদের শুভেচ্ছা বার্তায় লেখা ‘EAT MUBARAK!!!’ |
|